আল্লাহ তা’য়ালাই ফতোয়া দানকারী
#
‘ইফতাউন’ ক্রিয়ামূল থেকে জাত ‘ফতওয়া’ মূলক ব্যবহার কুরআনে ৯ টি। এর অর্থ বিধিবদ্ধ আইনের নির্দেশ বা বিধান বলে দেয়া।
কারাগারে সঙ্গীদ্বয়ের দু’টি স্বপ্নের বিষয়ে নবী ইউসুফ তাদের বলেন-
قُضِيَ الْأَمْرُ الَّذِي فِيهِ تَسْتَفْتِيَانِ
তোমরা যে বিষয়ে জানতে আগ্রহী তার ফতোয়া (সিদ্ধান্ত বা নিস্পত্তি) হয়ে গেছে। -১২:৪১
মিশরের বাদশাহ স্বপ্নে দেখল, সাতটি মোটাতাজা গাভী- এদেরকে সাতটি শীর্ণ গাভী খেয়ে যাচ্ছে এবং সাতটি সবুজ শীষ ও অন্যগুলো শুষ্ক। এই অদ্ভূত স্বপ্ন তাকে ভাবিয়ে তুলল, তাই তার রাজন্যবর্গের কাছে এ বিষয়ে ‘ফতোয়া’ চাইল।
يَا أَيُّهَا الْمَلَأُ أَفْتُونِي فِي رُؤْيَايَ إِنْ كُنْتُمْ لِلرُّؤْيَا تَعْبُرُونَ
হে পরিষদবর্গ! তোমরা আমাকে আমার স্বপ্নের বিষয়ে ফতোয়া (সিদ্ধান্ত) দাও বা ব্যাখ্যা বল (Explain to me), যদি তোমরা স্বপ্নের ব্যাখ্যায় পারদর্শী হয়ে থাক। -১২:৪৩
দীনের বিষয়ে ঈমানদারগণসহ অনেকেই শেষনবীকে বহু প্রশ্ন করত। সেটাই নীচের আয়াতদ্বয়ে এভাবে বলা হয়েছে যে, তারা তোমার কাছে ফতোয়া চায় (يَسْتَفْتُونَكَ); জবাবে আবার বলা হয়েছে যে- তুমি বলো, আল্লাহ তোমাদেরকে তাদের সম্বন্ধে ফতোয়া দিচ্ছেন। যেমন.
وَيَسْتَفْتُونَكَ فِي النِّسَاءِ قُلِ اللَّهُ يُفْتِيكُمْ فِيهِنَّ
আর নারীদের সন্বন্ধে তারা তোমার কাছে ফতোয়া (বিবাহের সিদ্ধান্ত বা অনুমতি) চায়। বলো- আল্লাহ্ তাদের সন্বন্ধে তোমাদের কাছে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। -৪:১২৭
يَسْتَفْتُونَكَ قُلِ اللَّهُ يُفْتِيكُمْ فِي الْكَلَالَةِ
মানুষ তোমার নিকট ফতোয়া জানতে চায় অতএব, তুমি বলে দাও, আল্লাহ্ তোমাদের বিধান বাতলে দিচ্ছেন মাতাপিতৃহীন তথা সন্তানসন্ততিহীনদের (কালালাহ) সন্বন্ধে। -৪:১৭৬
উপরের আয়াতদ্বয়ে যেখানে মানুষ ফতোয়া জানতে চায় বলে উদ্ধৃতি এসেছে, কুরআনের বহু ক্ষেত্রে আবার একই বিষয় ইয়াসআলুনাকা (يَسْأَلُونَكَ) বা তারা তোমার কাছে জানতে চায় বা প্রশ্ন করে – এভাবেও ব্যক্ত করা হয়েছে।
আর ঐ সমস্ত আয়াতের ক্ষেত্রে প্রায় অব্যবহিত পরেই আল্লাহ তাঁর রাসূলের উদ্দেশ্যে ‘তুমি বলো’ উল্লেখ করে সেই সব বিষয়ে আল্লাহর জবাব বা ফতোয়া মানব জাতিকে জানিয়ে দিয়েছেন।
বোধগম্যতার সুবিধা হবে চিন্তা করে সে সংক্রান্ত বেশ কিছু আয়াত আমি এখানে উপস্থাপন করছি।
১.
يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْأَهِلَّةِ قُلْ هِيَ مَوَاقِيتُ لِلنَّاسِ وَالْحَجِّ
তোমার নিকট তারা জিজ্ঞেস করে নতুন চাঁদের বিষয়ে। বলে দাও যে এটি মানুষের জন্য সময় নির্ধারণ এবং হজ্বের সময় ঠিক করার মাধ্যম। -২:১৮৯
২.
يَسْأَلُونَكَ مَاذَا يُنْفِقُونَ قُلْ مَا أَنْفَقْتُمْ مِنْ خَيْرٍ فَلِلْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِينَ وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينِ وَابْنِ السَّبِيلِ وَمَا تَفْعَلُوا مِنْ خَيْرٍ فَإِنَّ اللَّهَ بِهِ عَلِيمٌ
তারা তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে, তারা ব্যয় কী করবে? বলে দাও- ভালো জিনিস যা-কিছু তোমরা খরচ করো তা মাতাপিতার জন্য ও নিকট-আত্মীয়দের ও এতিমদের ও মিসকিনদের ও পথচারীদের জন্য। আর তোমরা যে কোন সৎকাজ করবে, নিঃসন্দেহে তা অত্যন্ত ভালভাবেই আল্লাহর জানা রয়েছে। -২:২১৫
৩.
يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ قُلْ فِيهِمَا إِثْمٌ كَبِيرٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَإِثْمُهُمَا أَكْبَرُ مِنْ نَفْعِهِمَا وَيَسْأَلُونَكَ مَاذَا يُنْفِقُونَ قُلِ الْعَفْوَ كَذَلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ لَكُمُ الْآَيَاتِ لَعَلَّكُمْ تَتَفَكَّرُونَ
তারা তোমাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলে দাও, এতদুভয়ের মধ্যে রয়েছে মহাপাপ। আর মানুষের জন্যে উপকারিতাও রয়েছে, তবে এগুলোর পাপ উপকারিতা অপেক্ষা অনেক বড়। আর তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে, কি তারা ব্যয় করবে? বলে দাও, নিজেদের প্রয়োজনীয় ব্যয়ের পর যা বাঁচে তাই খরচ করবে। এভাবেই আল্লাহ তোমাদের জন্যে নির্দেশ সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা চিন্তা করতে পার। -২:২১৯
৪.
يَسْأَلُونَكَ مَاذَا أُحِلَّ لَهُمْ قُلْ أُحِلَّ لَكُمُ الطَّيِّبَاتُ وَمَا عَلَّمْتُمْ مِنَ الْجَوَارِحِ مُكَلِّبِينَ تُعَلِّمُونَهُنَّ مِمَّا عَلَّمَكُمُ اللَّهُ فَكُلُوا مِمَّا أَمْسَكْنَ عَلَيْكُمْ وَاذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَيْهِ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ سَرِيعُ الْحِسَابِ
তারা তোমাকে জিজ্ঞাসা করছে কি তাদের জন্য হালাল হয়েছে। বলো- পবিত্র বস্তুসমূহ তোমাদের জন্য বৈধ হয়েছে। আর শিকারী পশুপক্ষীদের শিকার করতে যা শিখিয়েছ- তাদের তোমরা শিখিয়েছ যা আল্লাহ্ তোমাদের শিখিয়েছেন, কাজেই তারা তোমাদের কাছে যা ধরে আনে তা থেকে তোমরা খাও, তবে তার উপরে আল্লাহ্র নাম উল্লেখ করো। আর আল্লাহ্কে ভয়-ভক্তি করো। নিঃসন্দেহ আল্লাহ্ হিসেব-নিকেশে তৎপর। -৫:৪
৫.
يَسْأَلُونَكَ عَنِ السَّاعَةِ أَيَّانَ مُرْسَاهَا قُلْ إِنَّمَا عِلْمُهَا عِنْدَ رَبِّي لَا يُجَلِّيهَا لِوَقْتِهَا إِلَّا هُوَ ثَقُلَتْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ لَا تَأْتِيكُمْ إِلَّا بَغْتَةً يَسْأَلُونَكَ كَأَنَّكَ حَفِيٌّ عَنْهَا قُلْ إِنَّمَا عِلْمُهَا عِنْدَ اللَّهِ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ
তারা তোমাকে কেয়ামত সন্বন্ধে জিজ্ঞাসা করছে- কখন তা ঘটবে। বলো- এর জ্ঞান অবশ্যই রয়েছে আমার প্রভুর কাছে, এর সময় সন্বন্ধে তা প্রকাশ করতে পারে না তিনি ছাড়া কেউ। এ অতি গুরুতর ব্যাপার মহাকাশমন্ডলে ও পৃথিবীতে, এ এসে পড়বে না তোমাদের উপরে অতর্কিতে ছাড়া। তারা তোমাকে জিজ্ঞাসা করছে যেন তুমি তার অনুসন্ধানে লেগে আছো। বলো- এর জ্ঞান আলবৎ আল্লাহ্র কাছে, কিন্তু অধিকাংশ লোকই জানে না। -৭:১৮৭
৬.
يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْأَنْفَالِ قُلِ الْأَنْفَالُ لِلَّهِ وَالرَّسُولِ فَاتَّقُوا اللَّهَ وَأَصْلِحُوا ذَاتَ بَيْنِكُمْ وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ
তারা তোমাকে যুদ্ধে-লব্ধ ধনসম্পদ সন্বন্ধে জিজ্ঞাসা করছে। বলো- যুদ্ধে-লব্ধ ধনসম্পত্তি আল্লাহ্ ও রসূলের জন্য। সুতরাং আল্লাহ্কে তোমরা ভয়ভক্তি করো, আর তোমাদের নিজেদের মধ্যে সাব স্থাপন করো, আর আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলকে মেনে চলো যদি তোমরা মুমিন হও। -৮:১
৭.
وَيَسْأَلُونَكَ عَنِ الرُّوحِ قُلِ الرُّوحُ مِنْ أَمْرِ رَبِّي وَمَا أُوتِيتُمْ مِنَ الْعِلْمِ إِلَّا قَلِيلًا
আর তারা তোমাকে জিজ্ঞাসা করে রূহ সম্পর্কে। বলো- রূহ আমার প্রভুর নির্দেশাধীন, আর তোমাদের তো জ্ঞানভান্ডারের সৎসামান্য বৈ দেওয়া হয় নি। -১৭:৮৫
৮.
وَيَسْأَلُونَكَ عَنِ الْجِبَالِ فَقُلْ يَنْسِفُهَا رَبِّي نَسْفًا
আর তারা তোমাকে পাহাড়গুলো সন্বন্ধে জিজ্ঞাসা করে। কাজেই বলো- আমার প্রভু তাদের ছড়িয়ে দেবেন ছিটিয়ে ছিটিয়ে। -২০:১০৫
তারা আপনাকে পাহাড় সম্পর্কে প্রশ্ন করা। অতএব, আপনি বলুনঃ আমার পালনকর্তা পহাড়সমূহকে সমূলে উৎপাটন করে বিক্ষিপ্ত করে দিবেন।
৯.
يَسْأَلُونَكَ عَنِ السَّاعَةِ أَيَّانَ مُرْسَاهَا () فِيمَ أَنْتَ مِنْ ذِكْرَاهَا () إِلَى رَبِّكَ مُنْتَهَاهَا
তারা কেয়ামত সম্পর্কে তোমাকে জিজ্ঞাসা করে- কখন তার আগমন হবে? এ-সন্বন্ধে বলবার মতো তোমার কী আছে? এর চরম সীমা রয়েছে তোমার প্রভুর নিকট। -৭৯:৪২-৪৪
সুতরাং কুরআনের বহু আয়াত থেকে যেমন দেখা যায়, আল্লাহ তা’য়ালা যেমন তাঁর বাণী নাযিলকারী; একইসাথে তাঁর বাণীর ওয়াজকারী, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বা বয়ানকারী এবং তাফসিরকারী।
বিধান বা নির্দেশ জারীর ক্ষেত্রে তেমনি তিনি আবার বিধানাবলীর হুকুমকারী বা ফতোয়া দানকারীও বটে।
রাসূলের কাছে মানুষ বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত বা ফতোয়া চেয়েছে, কিন্তু রাসূল নিজে থেকে তাদের কোন ফতোয়া দান করেন নি। আল্লাহর দেয়া ফতোয়াই আল্লাহর বাণীরূপে তিনি তাদের শুনিয়ে দিয়েছেন এবং আমাদের জন্য রেখে গেছেন।
কিন্তু পরিহাসের বিষয়গুলো হলো, ধর্ম-বাণিজ্যের ডামাডোলে আল্লাহর এই অসাধারণ অভীধাগুলো কতিপয় স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী ছিনতাই করে নিয়ে গেছে যেন তারা এর দ্বারা পার্থিব কিছু নগণ্যমূল্য হাসিল করতে পারে।
ধর্ম-ব্যবসায়ীদের কাছে ধর্মান্ধতার ভিত্তিতে জিম্মি কুরআন বিমুখ আমজনতা এটা সেটার বিষয়ে যা কিছু জানতে চায়, আর তার মোকাবেলায় তাদেরকে সেই মোল্লাতন্ত্র যে বটিকা সেবন করিয়ে দেয়, সেগুলোকে ‘ফতোয়া’ বলে না।
আল্লাহর সকল সুন্নত, শরীয়াহ, হুকুমসহ পুরো কুরআন মাজীদই মানবজাতির জন্য পূর্ণ ফতোয়ার মহাগ্রন্থ। আমাদেরকে শুধু প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সেখান থেকে যথার্থ বিধানাবলীগুলো চিহ্নিত করে, এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যাচাই সাপেক্ষে আমাদের জীবনে প্রয়োগ করতে হবে মাত্র।
ইসলামের নামে পাহাড় পরিমাণ ভেজাল ও মিথ্যার চাপে কুরআনের বিশুদ্ধ দীন চাপা পড়ে গেছে। সত্যকে নতুন করে প্রতিষ্ঠা করার কিছু নেই; কুরআনুল কারীমের মহাসত্য আমাদের সাথেই সম্পূর্ণ অবিকৃতভাবে বিদ্যমান আছে। সেই মহাসত্যের উপর যুগ যুগান্তরের যে কালিমা লেপন করা হয়েছে তা ভালভাবে ঝেড়ে ফেললেই সেই শাশ্বত সত্য স্বমহিমায় আমাদের সামনে আবার উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে, ইনশা-আল্লাহ।
Sourse
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=3194954727203627&id=100000673936418
No comments:
Post a Comment